শিশু মনের খেয়াল রাখে মিনু বুধিয়ার Caring Minds
বিশেষ সন্তানের মা হিসেবে মিনু বুধিয়া জানতেন এই লড়াইটা ঠিক কেমন। জানতেন এমন পরিস্থিতিতে ঠিক কী প্রয়োজন। নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে তুলেছেন অ্যাডলাইফ, মানসিক বিকাশকেন্দ্র। কলকাতায় এ ধরনের সংস্থা এটাই প্রথম। ৩০ জনেরও বেশি পেশাদার এই সংস্থায় ক্লিনিক্যাল এবং নন ক্লিনিক্যাল পরিষেবা দিচ্ছেন।
বাবা,মা নিজের অপূর্ণতা সন্তানের মধ্যে দিয়ে পূরণ করতে চান। কিন্তু মিনু বুধিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা হয়ে গিয়েছিল উল্টো। ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। অসমের তিনসুকিয়ায় যেখানে তাঁর বেড়ে ওঠা, মেয়েদের জন্য বরাদ্দ ছিল শুধুই আর্টস। সায়েন্স পড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু নিজের স্পেশাল চাইল্ড প্রাচীর কথা ভেবে, প্রাচীকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলতে গিয়ে নিজেই মেন্টাল থেরাপির কোর্স করে নেন মিনু। ১৯৯০ সালের শেষের দিককার কথা বলছি। প্রাচী স্কুল যেতে শুরু করেছে সবে। প্রায় প্রতিদিন নালিশ আসা রুটিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। টিচাররা দুষ্টু বাচ্চা বলতেন। মা হিসেবে প্রথম খটকা লাগে মিনুর। কিন্তু সেই সময় কলকাতায় এখনকার মতো এতটা সুযোগ ছিল না। মেয়ের মন বুঝতে কোথায় যাবেন,কার কাছে নিয়ে যাবেন বুঝতে পারছিলেন না। বড্ড অসহায় লাগত। বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল মিনুর। মেয়ের চিকিৎসার জন্য বাইরে যান। যখন বুঝতে পারেন ওঁর মেয়ে স্বাভাবিক নয় তখন আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে পড়েন। ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকেন। প্রাচী যে স্পেশাল চাইল্ড এটা বুঝতে ৮ বছর সময় লেগে গিয়েছিল। মেনে নিতেই হত। ততদিনে নানারকম থেরাপি হয়ে গিয়েছে প্রাচীর। এখন বুঝতে পারেন, একেবারেই সেসব ঠিক হয়নি। নিজেও মানসিক অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। এই বিষয়গুলিকে আমাদের সমাজে এমন চোখে দেখে যে কেউ মুখও খুলতে চায় না, বলে চলেন মিনু। পরিস্থিতির সঙ্গে একবার মানিয়ে নিতে পারলেই আর কোনও সমস্যা নেই। আবার বিদেশে পাড়ি দেন, এবার আর মেয়ের চিকিৎসার জন্য নয়, বরং মেয়েকে কীভাবে বড় করবেন তার প্রশিক্ষণ নিতে। ফিলাডেলফিয়ায় শিশুর মানসিক বিকাশের ওপর বিশেষ কোর্স করেন। ফিরে মুম্বাইয়ে কৃপা ফাউন্ডেশনে কাউন্সেলিং কোর্স এবং তারপর লন্ডনে বিহেভিয়ার থেরাপির কোর্স। দেশে ফিরে স্টুডেন্ট কাউন্সিলর হিসেবে কাজ শুরু করেন জে ডি বিড়লা এবং সেন্ট জেভিয়ার্সে। নিজের সংস্থা খোলার আগে বেলেভিউতেও কিছুদিন কাজ করেন। বেলেভিউতে কাজ করার সময় প্রায়শই স্পিচ থেরাপি বা অন্য কোনও থেরাপির জন্য নানা জায়গায় রেফার করতে হত। তখনই ভাবতেন, সবকিছু এক ছাদের তলায় যদি নিয়ে আসা যায়। Addlife Caring Minds -এর জন্ম এই ভাবনা থেকেই, জানালেন বুধিয়া।
সাইকোমেট্রিক অ্যাসেসমেন্ট থেকে চিকিৎসা, ক্লায়েন্টের সাইকো এডুকেশন এবং ওয়ার্কশপ, থেরাপি, সাইকো সোশ্যাল রিহ্যারবিলেটেশন এবং তার পরবর্তী যা যা করণীয় অ্যাডলাইফ কেয়ারিং মাইন্ডস হল ওয়ানস্টপ সলিউশন। সাইকোমেট্রি, সাইকোথেরাপি,কাউন্সেলিং ছাড়াও এখানে স্পিচ অকোপেশানাল থেরাপি, রিমেডিয়াল এডুকেশন এবং বিহেভিয়ার ক্লিনিকও রয়েছে। একইসঙ্গে নিউরোলজি, সাইকাট্রি এবং নিউট্রিশন ইউনিটের সুবিধা পাওয়া যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে প্রথমে ওরা বাবা—মায়ের কাউন্সেলিং করেন। তাঁদের বোঝান আপনার সন্তান যেমন তেমনটা মেনে নিন। ছোট বা বড় অন্য সন্তানদের সঙ্গে তার তুলনা করলে চলবে না।
‘মেয়েকে ওই অবস্থায় যত দিন মেনে নিতে পারিনি নিজের সঙ্গে লড়ে গিয়েছি। না আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না মেয়ে। ওকে ওই অবস্থায় মেনে নিতেই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। প্রাচী আমাদের ভালো মানুষ হতে সাহায্য করেছে’, বুধিয়া বলে চলেন। ‘আমার সংস্থা শুধু বিশেষ বাচ্চাদের জন্যই নয় বরং সবার জন্য। বাচ্চাদের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ স্বাস্থ্যকর নয়। সব বাবা মা চান তাঁদের সন্তান ক্লাসে ফার্স্ট হোক। সন্তানের ছোটখাটো ভুলও মেনে নিতে চান না। ওয়ার্কিং বাবা মা বাচ্চাদের সবসময় কিছু না কিছুতে ব্যস্ত রাখেন, যাতে অবসর সময় খুব একটা না পাওয়া যায়। আজকালকার মায়েরা বাচ্চা খাচ্ছে না বলে বিরাট চিন্তায় পড়ে যান। বোঝানোর চেষ্টা করি সাধারণ পরিবারের বাচ্চারা না খেতে পেয়ে মারা যায় না। খিদে পেলেই খেয়ে নেবে। ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দিন’, অ্যাডলাইফ কেয়ারিং মাইন্ডসে প্যারেন্ট ওয়ার্কশপে এভাবেই বাবা মায়েদের বোঝান বুধিয়া।
অ্যাডলাইফ চার ধাপে কাজ করে। ক্লিনিক্যাল, ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, অ্যাকাডেমিয়া এবং মাইন্ড-স্পিক। ক্লিনিক্যাল উইংয়ে মনো-বিদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, স্পেশাল এডুকেটর, সাইকোথেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, হিয়ারিং অ্যান্ড ভয়েস ক্লিনিক পরিষেবা পাওয়া যায়। ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট উইংয়ে নানা বিষয়ে বাবা—মা, পড়ুয়া, শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিয়ে ওয়ার্কশপ হয়।
তৃতীয় ধাপে অ্যাকাডেমিয়া বেসিক কাউন্সেলিং কোর্স করায়। তাছাড়া প্লে থেরাপি, বিহেভিয়ার মোডিফিকেশন,লার্নিং ডিসঅর্ডার এইসব নিয়ে ছোট ছোট কোর্সও করানো হয়।
চতুর্থ ধাপে মাইন্ড স্পিক। এখানে প্রতি মাসে ওপেন ফোরামে কোনও বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে পারেন যে কেউ।
‘পঞ্চম ধাপে আই ক্যান ফ্লাই। এখানে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে যারা তাদের নানা রকম ভোকেশনাল ট্রেনিং, হাতের কাজ শেখানো হয়। ট্রেনিং শেষে নিজেরা অনলাইনে অথবা বাড়িতে বসে কাজ করতে পারে অথবা কিছু তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতে পারে। I CAN FLY এ যারা আসে তাদের সবার মুখে হাসি দেখতে চাই’, বলেন বুধিয়া।
সম্প্রতি ICAN FLY Cafe-র উদ্বোধন হল। রীতিমত ফিতে কেটে সেই কাফের উদ্বোধন করলেন পাশে মাকে নিয়ে প্রাচী। এভাবেই স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়ার বৃত্তটা পূর্ণ হল।
মায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন বুধিয়ার অপর কন্যা প্রিয়ম। শিল্পপতি সঞ্জয় বুধিয়ার মেয়ে বলে কথা ব্যবসার হাল ভালোই ধরেন। বলছিলেন, ‘সংস্থার ব্যবসার দিকটা আমি দেখি। পিআর, এইচআর সবটাই দেখতে হয়। যে পরিষেবা দিচ্ছি তার মান, ওয়ার্কশপের মান এবং আর কোথায় কোথায় ব্যবসা বাড়ানো যায় সবকিছু আমার মাথায় আছে। প্রতি ৬ মাস অন্তর নতুন কী আনা যায় সেই দিকটা ভেবে রাখি’, বলেন প্রিয়ম বুধিয়া। ‘মার্কেটিংটা ভালোই বোঝে আমার মেয়ে। আমি যখন ক্লিনিক্যাল উইং, ট্রেনিং এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি তখন ব্যবসার দিকটা প্রিয়ম ভালোই সামলে দেয়। ওর কাজে আমি নাক গলাই না। বরং ওর ওপর আমি এখন অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি’, হেসে বলেন মিনু।
বাবা সঞ্জয় বুধিয়াকে প্যাটনেও অনেকটা সাহায্য করেন প্রিয়ম। আগে অনেক বেশি ইনভলভড ছিলেন প্যাটনে। এখন কিন্তু বেশিরভাগ সময় দেন অ্যাডলাইফে। মা মেয়ে মিলে অ্যাডলাইফকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে চান। শহরেই আরেকটা শাখা খোলার পরিকল্পনা করেছেন। ফ্রেঞ্চাইজি দেওয়া যায় কিনা সেটা প্ল্যানিংয়ে রয়েছে বলে জানান প্রিয়ম।